গেটিসবার্গ কলেজে আন্ডারগ্র্যাজুয়েশন পড়তে আসার অন্যতম কারণ আমার জন্য ছিল রিসার্চের সুযোগ। তাই স্নাতক প্রথম বর্ষেই সামার রিসার্চ ফেলোশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম। কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের একমাত্র প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে সামার রিসার্চ করার সুযোগ পেয়েছিলাম।

আমি পড়ছি কেমিস্ট্রি নিয়ে। প্রথম বর্ষ শেষে কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর শুভ্রজিৎ সেনগুপ্তের সঙ্গে সামার রিসার্চের কাজ করলাম। রিসার্চে আমার আগ্রহ ছিল আগে থেকেই। সত্যিকারের রিসার্চ করার পর দারুণ ভালো লেগে গেল।

সেই রিসার্চ চালিয়ে গেলাম আমার দ্বিতীয় বর্ষেও। প্রফেসর সেনগুপ্ত আমার রিসার্চ প্রজেক্ট জমা দিয়েছিলেন আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের জন্য। ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগে সেই প্রজেক্ট পোস্টার প্রেজেন্টেশনের জন্য মনোনীত হল।

মার্চের ২০-২৪ তারিখ ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগো শহরের স্যান ডিয়েগো কনভেনশন সেন্টারে কনফারেন্স। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কেমিস্টরা আসবেন। পেন্সিলভানিয়া থেকে ক্যালিফোর্নিয়া সেই আট ঘণ্টার ফ্লাইট। তার উপর আবার প্রায় এক সপ্তাহ সেখানে থাকা-খাওয়া।

খরচের চিন্তায় যখন মাথায় হাত আমার, প্রভোস্টের অফিস থেকে ৭০০ ডলার আর গেটিসবার্গ কলেজ ক্রস ডিসিপ্লিনারি সাইন্স ইনস্টিটিউট থেকে ৫০০ ডলার গ্র্যান্ট পেলাম কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য।

কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট জানাল, বাকি যা খরচ লাগে-সবটা তারাই বহন করবে।

মার্চের ১৯ তারিখ খুব ভোরে চারজন প্রফেসর আর ১১ জন শিক্ষার্থী মিলে বাসে করে রওনা হলাম ওয়াশিংটন ডিসির ডালাস এয়ারপোর্টে। সেখান থেকে ভোর সাড়ে ছয়টার ফ্লাইটে স্যান ডিয়েগো। মাঝে ট্রানজিট পেলাম স্যান ফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টে।

সেখান থেকে যে বিমানে উঠলাম, সে বিমানভর্তি শুধু কনফারেন্সে অংশ নিতে আসা মানুষ। একজন প্রফেসরকে দেখলাম বিমানে বসেই পরীক্ষার খাতা দেখছেন।

স্যান ডিয়েগো এয়ারপোর্টে নেমে সিকিউরিটি পেরিয়ে বাইরে আসতেই দেখলাম আমাদের জন্য কনফারেন্সের শাটল অপেক্ষা করছে। দুটো মাইক্রোবাস। ড্রাইভাররা আমাদেরকে হাসিমুখে স্বাগত জানাল। পৌঁছে দিল স্যান ডিয়েগোর অন্যতম জনপ্রিয় এলাকা গ্যাসল্যাম্প কোয়ার্টারে আমাদের হোটেল ম্যারিয়টের রেসিডেন্স ইনে।

প্রতি দুজন করে একটা রুমে থাকার ব্যবস্থা। আমার থাকার বন্দোবস্ত হল আমার প্রফেসর ল্যাবের আরেকজন স্টুডেন্ট রিসার্চার কেইলির সাথে।

রুমে ঢুকে তো চক্ষু ছানাবড়া! আমাদের হোটেল রুমের সঙ্গে একটা রান্নাঘরও আছে। সেখানে মাইক্রোওয়েভ, ফ্রিজ, ডিশওয়াশার, ওভেন, চুলা, টোস্টার-সবকিছু আছে। লম্বা ফ্লাইটের পর সবারই ভীষণ ক্ষুধা লেগে গিয়েছিল। হাতমুখ ধুয়ে রেস্টুরেন্ট খুঁজতে বের হলাম খাওয়ার জন্য।

সেদিন দুপুরের খাবার পর স্যান ডিয়েগোতে থাকা এক বাংলাদেশি পরিবার আমাকে নিতে এলেন। মালা আপু আর তার স্বামী। তাদের সঙ্গে স্যান ডিয়েগো শহর ঘুরলাম। পরদিন থেকে কনফারেন্স শুরু।

আমার প্রেজেন্টেশন ছিল বুধবার। রবিবার থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত আমি কনফারেন্সে অন্যদের প্রেজেন্টেশন দেখে, বিভিন্ন সেশনে গিয়ে আর টুকটাক স্যান ডিয়েগো শহর ঘুরে কাটালাম।

বুধবার সকালে স্যুটকেস থেকে একটা শাড়ি বের করলাম, এক সেট সালোয়ার কামিজ আর এক সেট স্যুট-প্যান্ট। কেইলিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কি মনে হয় শাড়ি পরলে ওরা রাগ হবে? আমি তো ভয়ে প্রফেসর সেনগুপ্তকে জিজ্ঞেস করিনি। যদি না করে দেন।

কেইলি বলল, তুমি তোমার সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করবে এতে রাগ হবে কেন?

প্রফেসর সেনগুপ্তকে আমার সালোয়ার কামিজের ছবি পাঠিয়ে প্রথমে জানতে চাইলাম এটা পরতে পারি কিনা। তিনি বললেন, পারো।

এরপর শাড়ি পরতে পারি কিনা জানতে চাইলাম। বললেন, খুব কারুকাজ করা শাড়ি পরতে না করব। তার বাইরে যা ইচ্ছে পরো।

আমি মনে মনে উচ্ছ্বসিত হলেও ভয়ে ভয়ে আবার জানতে চাইলাম, আপনি নিশ্চিত তো, শাড়ি পরতে পারি?

এবার তিনি বললেন, তোমার যা ইচ্ছে তাই পরতে পারো। ফর্মাল হলেই চলবে।

ততক্ষণে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। শাড়ি পরে আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির উপবিভাগ ‘আন্তর্জাতিক কেমিস্ট’ থেকে পাওয়া কোটপিন শাড়িতে লাগিয়ে নিলাম।

আমি এখানে নিজেকে আন্তর্জাতিক মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি। আমেরিকা সব দেশের মানুষের মিলনমেলা। এখানে আমেরিকান হওয়ার চেষ্টা করতে আমার পছন্দ না। আমার ভালো লাগে নিজের পরিচয়, নিজের সংস্কৃতিকে গৌরবের সঙ্গে বহন করতে।

প্রফেসরের রুমে গেলাম আমার পোস্টার নিতে। যেহেতু আমি একা প্রেজেন্ট করব, তাই আমাকে সহযোগিতা করার জন্য প্রফেসর সেনগুপ্তও আমার সঙ্গে এলেন।

কনফারেন্সে এসে নির্ধারিত বোর্ডে পোস্টার টানিয়ে যখন অপেক্ষা করছি, স্যুট-প্যান্ট পরিহিতা এক ভদ্রমহিলা এসে ইংরেজিতে বললেন, তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। আমি ভারতীয়। কিন্তু আমি কখনো এমন কোনো জায়গায় শাড়ি পরার সাহস করে উঠতে পারিনি। অভিনন্দন তোমাকে, সাহসী মেয়ে।

আরো অনেকেই এসে আমার শাড়ির এবং শাড়ি পরার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে গেলেন। তাদের মধ্যে আমেরিকান ছাড়াও বেশ কয়েকজন ভারতীয় এবং বাংলাদেশি ছিলেন, যারা আমার শাড়ি দেখেই ধারণা করেছিলেন আমি ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এসেছি।

দুই ঘণ্টার পোস্টার প্রেজেন্টেশনের পর যখন আমরা ফেরার পথ ধরি, বাইরে তখন রাত নেমে গেছে। আলো ঝলমলে স্যান ডিয়েগো শহরের কোলাহলপূর্ণ প্রাণবন্ত পথে হাঁটতে হাঁটতে প্রফেসর সেনগুপ্ত বললেন, শাড়ি পরে একটা আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে প্রেজেন্টেশন দিয়ে ফেললে তবে!

আমি হাসতে হাসতে বললাম, কেন নয়?

প্রফেসর সেনগুপ্ত বললেন, শাড়িটা নিয়ে এসেছিলে। তুমি জানতে শাড়ি পরতে চাও। তাহলে আমাকে আজকে জিজ্ঞেস করলে কেন? আগে কেন না?

আমি বললাম, আগে জিজ্ঞেস করলে যদি নিষেধ করতেন? আজ জিজ্ঞেস করলাম। নিষেধ করলে বলতাম, আমি তো অন্যকিছু আনিনি কনফারেন্সে পরার মতো। কাজেই আপনাকে আমাকে শাড়ি পরতে দিতেই হত।

mim প্রফেসর সেনগুপ্ত আমার দিকে অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে বললেন, তুমি আসলে তুমিই!

সেটা ভালো নাকি খারাপ বুঝে উঠলাম না। বুঝতে চাইলামও না। আমি তখন কনফারেন্স থেকে হোটেলের পথ ধরা শত শত কেমিস্ট আর কাজ থেকে বাড়ির পথ ধরা শত শত মানুষের ভিড়ে আমেরিকার বড়, ব্যস্ত শহর স্যান ডিয়েগোর রাস্তায় হাঁটছি একটা সোনালি পাড়ের কালো শাড়ি পরে। যেটার দাম মাত্র ৭০০ টাকা।

শাড়িটা আমি অনলাইনে দেখে পছন্দ করে দেশে আমার মাম-বাপিকে কিনে রাখতে বলেছিলাম। তারা শাড়িটা কিনে সুদূর বাংলাদেশ থেকে পাঠিয়েছিল পৃথিবীর অন্য প্রান্তে আমেরিকায়। সেই শাড়ির সঙ্গে একটা চিঠি ছিল। আমার মায়ের চিঠি। আমার দেশের মাত্র ৭০০ টাকার শাড়ি-এতে আমার মামের হাতের ছোঁয়া আছে, আমার দেশের, আমার ঢাকা শহরের গন্ধ আছে। সেটা কি কেউ কখনো বুঝবে?

হাবিবা/আওয়াজবিডি/ইউএস

নড়াইলে সব স্কুল কলেজ মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ

ফেসবুকে ‘ধর্মানুভূতিতে আঘাত’, রাজশাহী কলেজের ছাত্রীকে ক্যাম্পাসে সাময়িক নিষিদ্ধ

ইবির অধীনে ফাযিল স্নাতক পরীক্ষার ফল প্রকাশ

শাড়িতে আমেরিকায় আন্তর্জাতিক কনফারেন্স জয়

ঈদে প্রাথমিকে ১৪, মাধ্যমিকে ১৭ দিনের ছুটি

রমজানে ক্লাসের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হচ্ছে: শিক্ষামন্ত্রী

ছুটি নিয়ে গুজব, রোজায় ঘোষিত সময়েই ক্লাস

রোজায় স্কুল-কলেজে ক্লাস চলবে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ রাসেলের নামফলক ভাঙচুর

মানিকগঞ্জে শিক্ষিকা-শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন

যশোর শিক্ষা বোর্ড কেলেঙ্কারি: চেয়ারম্যানসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

শিক্ষার্থীদের কাজকে সিটি করপোরেশনের হিসেবে প্রচার করে সমালোচনায় মেয়র